কেয়াম: ইতিহাস, প্রচলন, এবং ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

✍ লেখক: ML. QR, ARABIC MA, Ahammad Ali .

আপনি জানতে চেয়েছেন কেয়াম সম্পর্কে, অর্থাৎ মাহফিল বা মিলাদে দাঁড়িয়ে নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য দরুদ পাঠের প্রথা কবে থেকে চালু হয়েছে, কে চালু করেছে এবং ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে এর অবস্থান কী।

এই প্রসঙ্গে আমরা আলোচনা করব:

1. কেয়াম কী এবং এর প্রচলন কোথায় দেখা যায়?


2. এর উৎপত্তি এবং ইতিহাস


3. কুরআন, হাদিস ও সালাফদের দৃষ্টিভঙ্গি


4. ভারত ও বাংলায় এর প্রচলন


5. উপসংহার: ইসলামে কেয়ামের বৈধতা আছে কি না?






১. কেয়াম কী এবং এর প্রচলন কোথায় দেখা যায়?

কেয়াম বলতে বোঝানো হয় মাহফিল বা মিলাদে দাঁড়িয়ে নবীজির প্রশংসা করা, দরুদ পাঠ করা এবং নাত গাওয়া। অনেক জায়গায় এটিকে “কেয়াম” বা “খাড়া হয়ে মিলাদ” বলা হয়। সাধারণত এটি মিলাদ মাহফিলের শেষ অংশে করা হয়।

বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, পাকিস্তান, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অঞ্চলে বিশেষত সুফি তরিকার অনুসারীরা এটি পালন করে থাকেন।

কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, দাঁড়িয়ে নবীজির সম্মানে দরুদ পাঠ করলে তা বেশি ফজিলতপূর্ণ। অন্যদিকে, অনেক আলেম একে বিদআত বলে মনে করেন।




২. কেয়ামের উৎপত্তি এবং ইতিহাস

(ক) ইসলামের প্রথম যুগে কেয়ামের অস্তিত্ব ছিল কি?

নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে, সাহাবাদের যুগে, এমনকি তাবেয়ি ও তাবে-তাবেয়িনদের যুগে কেয়ামের কোনো প্রচলন ছিল না।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে, খোলাফায়ে রাশেদিন, বা বিখ্যাত চার ইমাম (আবু হানিফা, মালিক, শাফেয়ি, আহমদ ইবনে হাম্বল) কখনো এই আমল করেননি।

তাহলে এটি কোথা থেকে এলো?


(খ) ফাতিমি শাসকদের দ্বারা প্রথম প্রচলন

ইতিহাসবিদ Philip K. Hitti তাঁর History of the Arabs (Page 572) বইয়ে লিখেছেন:

> “The Fatimid rulers in Egypt were the first to introduce the public celebration of the Prophet’s birthday (Mawlid) in the 10th century.”
অর্থ: ফাতিমি শাসকরাই প্রথম ১০ম শতকে মিলাদ উদযাপন শুরু করে।



ফাতিমিরা ছিল শিয়া মতাদর্শের অনুসারী। তারা ইসলামের নামে অনেক নতুন রীতি চালু করেছিল।

পরবর্তীতে কিছু সুন্নি শাসকও এই প্রথাকে গ্রহণ করেন, বিশেষ করে মিশর ও সিরিয়াতে।


(গ) ভারত ও বাংলায় সুফি দরবেশদের মাধ্যমে প্রচলন

ভারতবর্ষে সুফি তরিকার লোকেরা কেয়াম ও মিলাদের প্রচলন করে।

বিশেষত চিশতিয়া, কাদেরিয়া ও নকশবন্দিয়া তরিকার অনুসারীরা এই রীতির প্রসার ঘটায়।

Sheikh Abdul Haq Muhaddith Dehlvi (মৃত্যু: ১৬৪২ খ্রি.) তাঁর গ্রন্থ Madarij-un-Nubuwwah (Volume 2, Page 72) এ লিখেছেন:

> “The standing in Mawlid gatherings (Qiyam) was not practiced by the Companions, nor by the Tabi’een. It was introduced later under the influence of some Sufi orders.”

অর্থ: সাহাবা বা তাবেঈনরা কেয়াম করতেন না। এটি পরবর্তীতে কিছু সুফি তরিকার মাধ্যমে চালু হয়।


“در مجالس مولد، قیام که به عنوان احترام به پیامبر (ص) انجام می‌شود، در زمان صحابه و تابعین معمول نبوده است؛ این عمل بعدها تحت تأثیر برخی از طریقت‌های صوفیه رواج یافت.”

বাংলা অনুবাদ: “মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠানে নবী (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে যে দাঁড়ানো হয়, তা সাহাবা ও তাবেঈনদের সময়ে প্রচলিত ছিল না; এই প্রথা পরবর্তীতে কিছু সুফি তরিকার প্রভাবে প্রসারিত হয়েছে।


৩. কুরআন, হাদিস ও সালাফদের দৃষ্টিভঙ্গি

(ক) কুরআনে কেয়ামের কোনো উল্লেখ আছে কি?

না, কুরআনের কোথাও মিলাদ বা কেয়ামের কোনো নির্দেশনা নেই।

(খ) হাদিস থেকে কী জানা যায়?

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

> “যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনে এমন কিছু সৃষ্টি করবে, যা এতে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।”
(সহিহ বুখারি: ২৬৯৭, সহিহ মুসলিম: ১৭১৮)



আরেকটি হাদিসে তিনি বলেন:

> “তোমরা আমার সুন্নত এবং আমার খোলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নত শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো। দ্বীনে নতুন নতুন সংযোজন থেকে দূরে থাকো, কারণ প্রতিটি নতুন সংযোজন বিদআত, আর প্রতিটি বিদআত গোমরাহী।”
(আবু দাউদ: ৪৬০৭, তিরমিজি: ২৬৭৬)



(গ) চার ইমামের বক্তব্য

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন:

> “যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নতের বিপরীতে নতুন কিছু প্রবর্তন করবে, সে বিদআতি।”
(আল-খিতত, আল-মাকরিজি, ২/২৮২)



ইমাম মালিক (রহ.) বলেন:

> “যদি কোনো নতুন ইবাদত ভালো হতো, তাহলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাহাবিরা এটি করতেন।”
(আল-ইতিসাম, ইমাম আশ-শাতিবি, ১/৩৭)







৪. উপসংহার: ইসলামে কেয়ামের বৈধতা আছে কি না?

✅ যা বৈধ:

নবীজির জন্য দরুদ পাঠ করা সুন্নত এবং অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।

নবীজিকে ভালোবাসা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।


❌ যা অবৈধ বা বিদআত:

দাঁড়িয়ে দরুদ পাঠ করা যদি কেউ ফরজ বা সুন্নত মনে করে, তাহলে তা বিদআত হয়ে যায়।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে এটি করেননি, সাহাবারা করেননি, চার মাযহাবের ইমামরাও করেননি।

এটি মূলত ফাতিমিদের মাধ্যমে চালু হয় এবং পরবর্তীতে ভারতবর্ষের কিছু সুফি তরিকার মাধ্যমে প্রসার লাভ করে।


সঠিক পদ্ধতি কী?

বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা

নবীজির সুন্নত মেনে চলা

ইসলামের শুদ্ধ আকিদা ও আমল চর্চা করা


শেষ কথা

কেয়াম ইসলামের প্রথম যুগে ছিল না। এটি পরে চালু হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রকৃত অনুসরণ হলো কুরআন ও সহিহ হাদিস অনুযায়ী আমল করা। নতুন কিছু সংযোজন করা বিদআত হিসেবে গণ্য হয়, যা থেকে দূরে থাকা উত্তম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *