ইসলামে বকশিশ দেওয়া ও নেওয়ার বিধান

লেখক: মাওলানা কারী আহাম্মদ আলী সাহেব
(আল কুরআন তালিম সেন্টার)

ইসলামী দৃষ্টিকোণে বকশিশের বিধান

ইসলামী শরীয়ত আমাদের জীবনের প্রতিটি দিক নিয়ে বিশদ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের লেনদেন, আচার-আচরণ এবং সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ইসলামের নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। বকশিশ বা টিপস চেয়ে নেওয়া এমন একটি বিষয়, যা অনেক সময় আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল বিষয়।

বকশিশের সংজ্ঞা

‘বকশিশ’ শব্দটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো উপহার বা অনুগ্রহ। সাধারণত এটি সেবা, ভালো কাজ, বা সন্তুষ্টি প্রকাশের জন্য দেওয়া হয়। এটি টিপস বা দান হিসেবেও বোঝানো হয়। ইসলামে উপহার বা দান গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু নৈতিক ও আদর্শিক দিকনির্দেশনা রয়েছে, যা একজন মুসলমানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ইসলামে দান ও উপহার গ্রহণের মূলনীতি

ইসলাম দানের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছে, তবে তা গ্রহণ ও প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম রয়েছে।

১. স্বেচ্ছায় প্রদানের গুরুত্ব

ইসলামে কোনো কিছু দেওয়ার ক্ষেত্রে তা স্বেচ্ছায় হওয়া জরুরি। দান বা বকশিশ এমন একটি বিষয়, যা কোনো চাপে বা নির্ধারিত চাহিদার ভিত্তিতে হওয়া উচিত নয়। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন:

> “তোমরা নিজেদের সম্পদ থেকে আল্লাহর পথে খরচ করো, কিন্তু এমনভাবে যেন তা মন থেকে আসে।”
(সুরা বাকারা: ২৬১)

২. চাওয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা

ইসলামে অহেতুক কিছু চাওয়া বা মানুষের কাছ থেকে প্রয়োজন ছাড়া কিছু চাওয়া নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:

> “যে ব্যক্তি মানুষের কাছে হাত পাতবে, সে নিজের জন্য জাহান্নামের এক টুকরো চাইবে।”
(সহীহ মুসলিম: ১০৪১)

তবে প্রয়োজন বা চরম অভাবের পরিস্থিতিতে সাহায্য চাওয়া বৈধ।

বকশিশ চেয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা

বকশিশ চেয়ে নেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে যদি কোনো ব্যক্তি এমন পরিস্থিতিতে থাকে যেখানে তার প্রয়োজন সত্যিই প্রকট, তবে ইসলামে এটি বৈধ হতে পারে।

চাওয়া বৈধ হওয়ার শর্তসমূহ:

১. প্রকৃত অভাব:
যদি ব্যক্তি তার প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে অক্ষম হয় এবং অন্য কোনো উপায় না থাকে, তবে বকশিশ বা সাহায্য চাওয়া বৈধ হতে পারে।

২. অক্ষমতা:
যদি কেউ কাজ করার সামর্থ্য না রাখে এবং তার জীবিকা নির্বাহের আর কোনো পথ না থাকে।

৩. ন্যায্য প্রতিদান:
যদি কোনো বৈধ কাজের প্রতিদানে কেউ স্বেচ্ছায় বকশিশ দিতে চায়, তবে তা গ্রহণ করা যাবে।

চাওয়া না করেও বকশিশ পাওয়া:

যদি কোনো ব্যক্তি চাওয়া ছাড়াই বকশিশ পায় এবং এটি তার কাছে হালাল সম্পদ হিসেবে আসে, তবে তা গ্রহণ করা বৈধ।

ইখলাস ও বিনয়ের গুরুত্ব

ইসলামে কোনো কিছু গ্রহণের আগে ইখলাস বা বিশুদ্ধ উদ্দেশ্য বজায় রাখা জরুরি। দান বা বকশিশ গ্রহণের সময় কৃতজ্ঞতা ও বিনয় প্রকাশ করা উচিত। বকশিশ গ্রহণ করলে তা এমনভাবে নেওয়া উচিত যেন তা অন্যের মনে কোনো রকম অস্বস্তি সৃষ্টি না করে।

উপসংহার

ইসলামী দৃষ্টিকোণে বকশিশ চেয়ে নেওয়া প্রয়োজন ছাড়া উচিত নয়। এটি মানুষের প্রতি আস্থা ও সম্মানের নীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। একজন মুসলমানের উচিত নিজের প্রতি আস্থা রাখা এবং সৎভাবে উপার্জনের চেষ্টা করা। অন্যদিকে, যাঁরা আর্থিকভাবে সচ্ছল, তাঁদের উচিত দান করার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং অভাবী মানুষদের সাহায্য করা।

অতএব, ইসলামে বকশিশ বা দান গ্রহণের ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও আত্মসম্মান বজায় রাখা অপরিহার্য। কেবলমাত্র প্রকৃত প্রয়োজনের ক্ষেত্রে চাওয়া এবং তা গ্রহণ করা শরীয়তের সীমার মধ্যে পড়ে।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তৌফিক দিন। আমিন।

বকশিশ দেওয়ার বিধান

১. স্বেচ্ছা ও আন্তরিকতার সঙ্গে প্রদান করা

ইসলামে দান করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, তবে তা হতে হবে স্বেচ্ছায় এবং আন্তরিকতার সঙ্গে। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন:

> “তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে ব্যয় করো।”
(সুরা আলে ইমরান: ৯২)

২. গোপনে দান করা উত্তম

দান বা বকশিশ দেওয়ার ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। কুরআনে বলা হয়েছে:

> “যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান করো, তবে তা ভালো। কিন্তু যদি গোপনে দান করো এবং দরিদ্রদের দাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরও ভালো।”
(সুরা বাকারা: ২৭১)

৩. অন্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ

দান বা বকশিশ দেওয়ার মাধ্যমে অন্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:

> “যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।”
(তিরমিজি: ১৯৫৪)

বকশিশ নেওয়ার বিধান

১. চাওয়া ছাড়াই গ্রহণ করা

ইসলামে কোনো ব্যক্তি চাওয়া ছাড়াই কিছু পেলে, সেটি গ্রহণ করা বৈধ। হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:

> “যে সম্পদ তার কাছে চাওয়া ছাড়া আসে এবং সে এতে লোভ করে না, তা সে গ্রহণ করতে পারে।”
(সহীহ বুখারি: ১৪৭৩, সহীহ মুসলিম: ১০৪৫)

২. চাওয়া নিরুৎসাহিত করা

অহেতুক চাওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:

> “যে ব্যক্তি মানুষের কাছে হাত পাতবে, কেয়ামতের দিন তার মুখে কোনো মাংস থাকবে না।”
(সহীহ বুখারি: ১৪৭৪, সহীহ মুসলিম: ১০৪১)

তবে যদি প্রকৃত অভাবগ্রস্ত হয়, তাহলে সাহায্য চাওয়া বৈধ।

৩. কাজের প্রতিদান স্বরূপ গ্রহণ করা

যদি কোনো ব্যক্তি তার কাজের প্রতিদানে বকশিশ পায় এবং তা হালাল উপার্জন হয়, তবে তা গ্রহণ করা বৈধ।

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে দানের উদ্দেশ্য

ইসলামে দান বা বকশিশ দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো দরিদ্রদের সাহায্য করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। এটি আত্মশুদ্ধি এবং সম্পদের পবিত্রতার জন্য একটি মাধ্যম। কুরআনে বলা হয়েছে:

> “তোমরা তোমাদের সম্পদ থেকে আল্লাহর পথে দান করো।”
(সুরা বাকারা: ১৯৫)

বকশিশের প্রাসঙ্গিক পরিস্থিতি

বকশিশ দেওয়া বৈধ ও উত্তম যখন:

1. সেবা বা কাজের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশের জন্য।

2. অভাবগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য।

3. নিজের ইচ্ছা ও সামর্থ্যের মধ্যে থেকে।

বকশিশ নেওয়া বৈধ যখন:

1. যখন এটি চাওয়া ছাড়া প্রদান করা হয়।

2. যখন এটি কাজের বৈধ প্রতিদান।

3. যখন অভাবগ্রস্ত ব্যক্তির প্রয়োজন মেটানোর জন্য দেওয়া হয়।

সারসংক্ষেপ

ইসলামে বকশিশ দেওয়া ও নেওয়া উভয়ই নির্দিষ্ট শর্তের ভিত্তিতে বৈধ। বকশিশ দিতে হলে তা হতে হবে স্বেচ্ছায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। অন্যদিকে, বকশিশ নেওয়া উচিত কাজের বৈধ প্রতিদান বা প্রয়োজন পূরণের জন্য। অহেতুক বা জোর করে কিছু চাওয়া ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে দানের সঠিক নিয়ম অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন এবং বিনয় ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জীবনযাপন করার তাওফিক দিন। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *